ইলিশ মাছ উৎপাদনে অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশা

সেলিনা আক্তার : দেশের আপামর জনসাধারণের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকারত্ব হ্রাস, দারিদ্র্যমোচন, রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ দশমিক ২২ শতাংশ, যার বাজারমূল্য ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশের অধিক। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বাঙালির অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু এ মাছ যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আমিষ জাতীয় খাদ্য সরবরাহে এ মাছ অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ইলিশ দেশের জাতীয় সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষায় দেশের প্রত্যেক নাগরিকদের এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। ইলিশের সহনশীল উৎপাদন বজায় রাখার লক্ষ্যে ডিমওয়ালা মা ইলিশ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা ইলিশ রক্ষা পেলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ১৭ আগস্ট ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ইলিশ শীর্ষক ভৌগোলিক নিবন্ধন সনদ (জিআই সনদ) প্রাপ্তিতে নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ইলিশ এখন সমাদৃত। দেশের প্রায় ৭ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষভাবে এবং ২৫ লক্ষ লোক পরোক্ষভাবে ইলিশ আহরণ, বিক্রয় ও বিপণনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠন পরিকল্পনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে এ খাতের উন্নয়ন ও বিকাশে নানা দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, “আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমার মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাল্লাহ, এই দিন আমাদের থাকবে না”। বঙ্গবন্ধুর সূচিত পথ ধরে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা যথাযথ বাস্তবায়নের ফলে মৎস্য খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে-বিদেশে ইলিশের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। একক মৎস্য প্রজাতি হিসেবে বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সবচেয়ে বেশি । ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ রোল মডেল এবং পৃথিবীর প্রায় দুই—তৃতীয়াংশের অধিক ইলিশ আহরণকারী বাংলাদেশ ইলিশের দেশ হিসেবে খ্যাত। ৬.৭১ লক্ষ মেট্রিকটন ইলিশ মাছ আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ   বঙ্গবন্ধু , ওআইসি এবং সাম্প্রতিকতা

ইলিশ পছন্দ করে না, এমন বাঙালি দেশে ও বিদেশে খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। ইলিশ স্বাদে ও গুণে সত্যিই অতুলনীয়। সাগর ও নদী দুই জায়গাই ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র। বিগত বছরগুলোয় ইলিশ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল এবং এমন প্রেক্ষাপটে মা ইলিশ শিকারের ওপর অবরোধসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে।পদ্মা ও মেঘনা ইলিশের প্রধান বিচরণক্ষেত্র।দূষণের কারণে এ নদীর পানির গুণগত মান ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে কমছে ইলিশের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের পরিমাণ। ইলিশ গবেষকরা বলছেন, এর ফলে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ইতোমধ্যেই নদীতে ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে। ইলিশের বিচরণক্ষেত্রের পানির মান সরকারের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করে আসছে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও-ডিসলভ অক্সিজেন), পিএইচ, পানি ও বায়ুর তাপ, হার্ডনেস (ক্ষারত্ব), অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। পদ্মায় গত পাঁচ বছরে ডিওর মান কমেছে। ২০১৮ সালে পদ্মার পানিতে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৭০ এবং এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছর কমছে। ২০২২ সালে ডিওর মান ছিল ৫ দশমিক ৪১। মেঘনায় ২০১৮ সালে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৪০ এবং এটি ২০২২ সালে কমে ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ হয়েছে। নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাসায়নিক যৌগ হলো অ্যামোনিয়া। যে পানির মান ভালো, সেখানে এর উপস্থিতি শূন্য থাকে। পদ্মায় ২০১৮ সালে পানিতে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি ছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। গত বছরও তা-ই ছিল। কিন্তু মেঘনায় পানিতে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ এবং এটি গত বছর শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে, অ্যাসিড ও ক্ষারের পরিমাপক হলো পিএইচ। জলজ প্রাণীর সহনীয় পরিবেশের ক্ষেত্রে পিএইচ সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮-এর মধ্যে থাকে কিন্তু কোনভাবেই ৭-এর নিচে নয়। পদ্মা নদীতে পিএইচের গড় উপস্থিতি ছিল ৮ এবং গত বছর এর পরিমাণ কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭। মেঘনায় ২০১৮ সালে পিএইচের উপস্থিতি ছিল ৮ দশমিক ১৩ এবং ২০১৮ থেকে ২০২২-এর মধ্যে পদ্মায় পানির তাপমাত্রা প্রায় ২৫ থেকে বেড়ে ৩০ ডিগ্রি হয়েছে। এ সময় অবশ্য মেঘনায় পানির তাপ ২৭ দশমিক ৪০ থেকে কমে প্রায় ২৭ হয়েছে। জলজ প্রতিবেশে দূষণ যেকোনো মাছের জন্যই ক্ষতিকর। তবে ইলিশ অনেক বেশি সংবেদনশীল মাছ এবং দূষণের ফলে প্রতিবেশের সামান্য পরিবর্তন ইলিশ নিতে পারে না।

আরও পড়ুনঃ   আত্মহত্যা: অবর্ণনীয় যন্ত্রণার অন্তহীন পথ

মাইলিশমূলতবছরেসাধারণতদু’বারডিমদেয়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (ভাদ্রমাসথেকেমধ্যকার্তিক) ওজানুয়ারিথেকেফেব্রুয়ারি (মধ্যপৌষথেকেমধ্যফালগুন)। তবেদ্বিতীয়মৌসুমেরতুলনায়প্রথমমৌসুমেপ্রজননহারবেশি। একটিমাইলিশপ্রতিমৌসুমেএকবারেসর্বোচ্চ১থেকে২.৩মিলিয়নঅর্থাৎ১০থেকে২৩লাখডিমদেয়। ইলিশপোনা৬-১০সপ্তাহে১২সেমিথেকে২০সেমিপর্যন্তবড়োহয়। তখনএদেরজাটকাবলে। একটিজাটকামাছপূর্ণাঙ্গইলিশেপরিণতহতেসময়লাগে১থেকে২বছর। তখনআয়তনে৩২সেমিথেকে৬০সেমিএবংওজনে১থেকে৩কেজিপর্যন্তহয়েথাকে। জাটকামাইলিশেরসাথেসমুদ্রেচলেযায়। সেখানেপূর্ণাঙ্গইলিশেপরিণতহয়েআবারপ্রজননকালেরনদীতেফিরেআসে। দেশেরসবনদ-নদী, মোহনা, উপকূলীয়এলাকায়ডিমছাড়েইলিশ। মেঘনানদীরঢলচর, মনপুরাদ্বীপ, মৌলভীরচরওকালিরচরএলাকাকেইলিশেরপ্রধানপ্রজননক্ষেত্রধরাহয়, যারআয়তনপ্রায়৭হাজারবর্গকিলোমিটার। বর্তমানেদেশেরপ্রায়নদ-নদীতেপাওয়াযাচ্ছেইলিশ। এরপ্রধানআহরণএলাকাহচ্ছে- মেঘনানদীরনিম্নাঞ্চল,

তেঁতুলিয়া, কালাবদর বা আড়িয়াল খাঁ ধর্মগঞ্জ নয়াভাাঙানি , বিষখালি পায়রা, রূপসা, শিবসা, পশুর কচা, লতা, লোহাদিয়া, আন্ধারমানিকসহ অনেক মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চল। আমাদের দেশে প্রদানত তিন প্রকারের ইলিশ পাওয়া যা। ইলিশ, চন্দনা ইলিশ ও গুর্তা বা কানগুর্তা ইলিশ। টর্পেডা আকৃতির রূপালি রংয়ের মাছ পৃষ্টদেশ কিছুটা কালচে আভা। আরও চার প্রজাতির ইলশ বাংলাদেশ উপকূলে পাওয়া যায়।
স্বাদে, ঘ্রাণে, রূপেঅন্যান্যমাছকেপেছনেফেলেইলিশবাঙালিসমাজে ‘মাছেররাজা’ হিসেবেসমাদৃত। শুধুযেরূপেগুণেবিষয়টাএমনওনা, অন্যান্যমাছেরপুষ্টিগুণেরদিকথেকেওএগিয়েআছেএইসমুদ্রথেকেআসানদীররাজা। ইলিশমাছরোগপ্রতিরোধেওসহায়ক। ইলিশমাছহার্টসুস্থরাখে, রক্তসঞ্চালনওবাতনিয়ন্ত্রণেরসহায়ক, রাতকানারোধে, ক্যান্সারমোকাবিলায়, হাঁপানিরোধে, অবসাদদূরকরতে, ত্বকেরযত্নে, শিশুদেরমস্তিষ্কেরগঠনকরতেসহায়ক। গবেষণায়দেখাগেছে, ইলিশেআছেউচ্চমাত্রারপ্রোটিন। তাছাড়াওআছেওমেগাথ্রিফ্যাটিঅ্যাসিড, যারক্তেরকোলেস্টেরলওইনসুলিনেরমাত্রাকমিয়েদেয়, ফলেহার্টসুস্থথাকে। তাইহৃদরোগীদেরজন্যইলিশেরতেলউপকারী। ইলিশমাছেস্যাচুরেটেডফ্যাটেরপরিমাণএকেবারেইকম।
সরকারেরনানামুখীউদ্যোগেইলিশেরউৎপাদনআশাতীতভাবেবেড়েছে। ২০০৮-০৯অর্থবছরেইলিশেরআহরণছিল২দশমিক৯৮লাখমেট্রিকটন। ২০২২-২৩অর্থবছরে৫দশমিক৭১লাখমেট্রিকটনেউন্নীতহয়েছে। পরিসংখ্যানঅনুসারে১৫বছরেইলিশেরউৎপাদনবেড়েছেপ্রায়৯২শতাংশ।
ইলিশ সম্পদ বাড়লেও যদি এর মৌলিকত্ব ধরে রাখা না যায় তবে অদূর ভবিষ্যতে দেশে-বিদেশে ইলিশের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে যাবে। মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে অংশীজনের মাঝে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে নিয়মিত সচেতসতামূলক সভা আহবান,ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।নদী দুষণরোধ এবং ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে সকলকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
#
পিআইডি ফিচার