ইতিকাফ মাহে রমজানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত

এম জসীম উদ্দিন : ‘ইতিকাফ’ আরবি শব্দ। এর অর্থ অবস্থান করা,আবদ্ধ করা বা আবদ্ধ রাখা। ইসলামি পরিভাষায় ইবাদতের উদ্দেশ্যে ইতিকাফের নিয়তে নিজেকে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবদ্ধ রাখাই হচ্ছে ইতিকাফ। ইতিকাফ কারিকে ‘মুতাকিফ’ বলে। রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ (সা:) নিজে ইতিকাফ করতেন। সাহাবায়ে কেরামও ইতিকাফ করতেন। ইতিকাফে মুসলমানগণ আল্লাহর জিকির ও ইবাদতের মাধ্যমে শবে কদর তালাশ করে। সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে রহমত,মাগফেরাত ও নাজাত কামনা করে থাকেন। তাইতো ইতিকাফ মাহে রমজানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

“রমযনেররোযাইসলামেরপাঁচস্তম্ভেরঅন্যতম।ঈমান, নামাযওযাকাতেরপরইরোযারস্থান।রোযারআরবিশব্দসওম, যারআভিধানিকঅর্থবিরতথাকা।পরিভাষায়সওমবলাহয়-প্রত্যেকসজ্ঞান, বালেগমুসলমাননর-নারীরসুবহেসাদিকথেকেসূর্যাস্তপর্যন্তরোযারনিয়তেপানাহার, স্ত্রীসহবাসওরোযাভঙ্গকারীসকলকাজথেকেবিরতথাকা।সুতরাংরমযানমাসেরচাঁদউদিতহলেইপ্রত্যেকসুস্থ, মুকীমপ্রাপ্তবয়স্কপুরুষএবংহায়েয-নেফাসমুক্তপ্রাপ্তবয়স্কানারীরউপরপূর্ণরমযানরোযারাখাফরয।এসম্পর্কেআল্লাহতাআলাইরশাদকরেছেন-
يَاأَيُّهَاالَّذِينَآَمَنُواكُتِبَعَلَيْكُمُالصِّيَامُكَمَاكُتِبَعَلَىالَّذِينَمِنْقَبْلِكُمْلَعَلَّكُمْتَتَّقُونَ
(তরজমা) হেঈমানদারগণ! তোমাদেরউপররোযাফরযকরাহয়েছে, যেমনফরযকরাহয়েছিলতোমাদেরপূর্ববর্তীদেরউপর, যেনতোমরামুত্তাকীহতেপার।-সূরাবাকারা (২) : ১৮৩
অন্যআয়াতেইরশাদকরেছেন- فَمَنْشَهِدَمِنْكُمُالشَّهْرَفَلْيَصُمْهُ (তরজমা)সুতরাংতোমাদেরমধ্যেযেব্যক্তিইএমাসপাবে, সেযেনঅবশ্যইরোযারাখে।- সূরাবাকারা (২): ১৮৫

ফরজইবাদতব্যতিতআল্লাহরনৈকট্যলাভেরজন্যযেসবইবাদতকরাহয়তারমধ্যেইতেকাফএকটিঅন্যতমইবাদত।রমজানেররহমত, বরকতওনাজাতলাভেরঅশায়মাহেরমজানেরমর্যাদাকেকাজেলাগিয়েহাজারবছরেররশ্রেষ্ঠরজনীপবিত্রলাইলাতুলকদরপ্রাপ্তিরসুনিশ্চিতপ্রত্যাশায়সর্বোপরিমহানআল্লাহরনৈকট্যলাভেরজন্যরমজানেরশেষদশকেরইতিকাফঅত্যন্তফজিলতপূর্ণইবাদত।”

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘এবং স্মরণ কর যখন আমি কা‘বা গৃহকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র এবং নিরাপদস্থল করলাম এবং(আদেশ দিলাম), ‘তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সলাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর’ এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে বলেছিলাম, ‘আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ই‘তিকাফকারী এবং রুকূ ও সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখবে’(সূরা আল বাকারা, আয়াত :১২৫)। আর মসজিদে যখন তোমরা ইতিকাফ অবস্থায় থাকবে তখন স্ত্রী-সম্ভোগ থেকে বিরত থেকো। সিয়ামের ব্যাপারে এগুলোই হলো আল্লাহর সীমারেখা’ (সূরা আল বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। রাসূলুল্লাহ (সা:) রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন (বুখারি-২০২৫)। রাসূলুল্লাহ (সা:) রমজানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন, ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন (বুখারি-২০২৬)।আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, ‘কেউ যখন আল্লাহর ঘর মসজিদে অবস্থান নেয় তখন আল্লাহ তায়ালা এত বেশি আনন্দিত হন যেমন বিদেশ-বিভুঁই থেকে কেউ বাড়িতে এলে আপনজনরা আনন্দিত হয়ে থাকে’ (তারগিব-তারহিব:৩২২)।

মূলত ২০ শে রমজান সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগ থেকে ২৯/৩০ তারিখ অর্থাৎ যেদিন ঈদের চাঁদ দেখা যাবে সেই দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত মেয়েদের জন্য নিজ গৃহে নামাজ পড়ার নির্ধারিত স্থানে এবং পুরুষদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে পড়া হয় এমন মসজিদে দুনিয়ার কাজ কর্ম পরিত্যাগ করে একাগ্রতার সাথে আল্লাহর ধ্যানে পাবন্দীর সাথে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ শুরুর পর কেবল বাথরুম কিংবা পানাহারের একান্ত প্রয়োজনে অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ থাকে। তবে খাবার মসজিদে পৌঁছানোর লোক থাকলে খাবারের জন্য অন্যত্র যাওয়া যাবে না। ইতিকাফ অবস্থায় কোরআন তেলোয়াত সহ বেশি বেশি নফল ইবাদত করা উত্তম। ইতিকাফ অবস্থায় মহিলাদের হায়েয বা নেফাস আসলে ইতিকাফ ছেড়ে দেবে কেননা এমতাবস্থায় ইতিকাফ করা জায়েজ নয়। ইতিকাফের জন্য তিনটি বিষয় জরুরি: (ক) পুরুষের মসজিদে অবস্থান করা, যেখানে নামাজের জামাত হয় (খ) ইতিকাফের নিয়তে অবস্থান করা (গ) হায়েয-নেফাস ও গোসলের প্রয়োজন থেকে পাক হওয়া।
ইতিকাফ তিন প্রকার: (১) ওয়াজিব (২) সুন্নতে মুয়াক্কাদা (৩) মুস্তাহাব। ওয়াজিব ইতিকাফ হলো মান্নতের ইতিকাফ। মান্নত বিনা শর্তেও হতে পারে আবার শর্ত সাপেক্ষে ও হতে পারে। বিনা শর্তে যেমন কেউ বলল, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে তিন দিনের জন্য ইতিকাফ করব। শর্তসাপেক্ষে যেমন কেউ বলল, আমার ওই কাজটি সম্পন্ন হলে আমি ইতিকাফ করবো। সুন্নতে মুয়াক্কাদা হল রমজানের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফ। ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া অর্থাৎ কমপক্ষে মহল্লার কোন একজন ইতিকাফ করলে সকলেই দায়িত্বমুক্ত হবে। আর মুস্তাহাব ইতিকাফ হল রমজানের শেষ দশ দিন ব্যতীত প্রথম দশ দিন বা মধ্যবর্তী দশ দিন বা অন্য কোন মাসে ইতিকাফ করা। ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত, যখনই ইতিকাফ করবে তখনই রোজা রাখতে হবে। ওয়াজিব ইতিকাফ কমপক্ষে একদিন হতে হবে, যত বেশি দিনের মান্নত করবে ততদিন ওয়াজিব হবে।

আরও পড়ুনঃ   হাওরের উন্নয়নে কাজ করতে হবে

ইতিকাফ অবস্থায় দুটি কাজ করা হারাম। এই দুটি কাজ করলে ওয়াজিব ও সুন্নত ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায় এবং কাজা করতে হয়। আর মুস্তাহাব ইতিকাফ শেষ হয়ে যায়। কারণগুলো হচ্ছে (১) ইতিকাফের স্থান হতে স্বাভাবিক বা শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া। স্বাভাবিক প্রয়োজন যেমন প্রস্রাব পায়খানা, ফরজ গোসল, খাওয়ানোর লোক না থাকলে খাবার আনতে যাওয়া। শরয়ী প্রয়োজন যেমন জুমার নামাজ আদায় করতে যাওয়া।
ইতিকাফ অবস্থায় বিনা প্রয়োজনে দুনিয়াদারীর কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ তাহরীমী। যেমন বিনা প্রয়োজনে কেনাবেচা বা ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কাজ করা। অবশ্য যে কাজ একান্ত প্রয়োজন যেমন ঘরে কোন খোরাকী নেই, বিশ্বাসী লোকও নেই যার মাধ্যমে কেনাবেচা করানো যায় , তবে এমতাবস্থায় কেনাবেচা করা জায়েজ। কিন্তু মালপত্র মসজিদে আনা কোন অবস্থাতেই জায়েজ নয়। তবে যদি মসজিদে আনলে মসজিদ নষ্ট হওয়া কিংবা জায়গা আবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা না থাকে তবে কেউ কেউ এটাকে জায়েজ বলেছেন। ইতিকাফ অবস্থায় বেশি বেশি আল্লাহর জিকির-আজকার করা, নফল নামাজ আদায় করা, কোরআন তেলাওয়াত করা,দ্বীনি ওয়াজ-নসিহত শোনা ও ধর্মীয় গ্রন্থাবলী পাঠকরা উত্তম।

ইতিকাফের মাধ্যমে শবে কদর খোঁজ করা রাসূলুল্লাহ(সা:) এর মূল উদ্দেশ্য ছিল। আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত হাদিস সে কথারই প্রমাণ বহন করে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: আমি প্রথম দশকে ইতিকাফ করেছি এই (কদর) রজনী খোঁজ করার উদ্দেশ্যে, অতঃপর ইতিকাফ করেছি মাঝের দশকে, অত:পর মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম, তারপর আমাকে বলা হল, (কদর) তো শেষ দশকে। অত:পর লোকেরা তাঁর সাথে ইতিকাফ করল [মুসলিম: হাদিস নং ১১৬৭]। দাওয়াত, তাযকিয়া, জিহাদ ও শিক্ষার কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও প্রতি রমজানে তিনি ইতিকাফ করতেন। ইতিকাফ আত্মশুদ্ধি ও ঈমানি তরবিয়তের একটি শিক্ষালয় যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিদায়াতী আলোর মূর্ত প্রতীক। ইতিকাফরত অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্যান্য সকল বিষয় থেকে আলাদা করে নেয়। ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নেকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধানায়। ইতিকাফ ঈমান বৃদ্ধির একটি মুখ্য সুযোগ। সকলের উচিত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ঈমানি চেতনাকে শাণিত করে তোলা ও উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা। ইতিকাফের ফলে আল্লাহ তা’আলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়, এবং আল্লাহ তা’আলার জন্য মস্তক অবনত করার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। কেননা আল্লাহ বলেন-‘আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমারই এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি [সূরা আজ-জারিয়াত : ৫৬]। আর এ এবাদতের বিবিধ প্রতিফলন ঘটে ইতিকাফ অবস্থায়। কেননা ইতিকাফ অবস্থায একজন মানুষ নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ইবাদতের সীমানায় বেঁধে নেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আল্লাহ তা’আলাও তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ করেন না, বরং তিনি বান্দাদেরকে নিরাশ হতে নিষেধ করে দিয়ে বলেছেন-‘(হে নবী আপনি) বলুন, আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। [সুরা যুমার : ৫৩]।
ইতিকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়ার কারণে মুসলমানদের অন্তরের কঠোরতা দূরীভূত হয়, কেননা কঠোরতা সৃষ্টি হয় দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও পার্থিবতায় নিজেকে আরোপিত করে রাখার কারণে। মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখার কারনে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসায় ছেদ পড়ে এবং আত্মিক উন্নতির অভিজ্ঞতা অনুভূত হয়। মসজিদে ইতিকাফ করার কারণে ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে, ফলে ইতিকাফকারী ব্যক্তির আত্মা নিম্নাবস্থার নাগপাশ কাটিয়ে ফেরেশতাদের স্তরের দিকে ধাবিত হয়। ফেরেশতাদের পর্যায় থেকেও বরং উর্ধ্বে ওঠার প্রয়াস পায়। কেননা ফেরেশতাদের প্রবৃত্তি নেই বিধায় প্রবৃত্তির ফাঁদে তারা পড়ে না। আর মানুষের প্রবৃত্তি থাকা সত্বেও সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য একাগ্রচিত্ত হয়ে যায়।
তাই আসুন পবিত্র মাহে রমজানের গুরুত্বপূর্ণ এই এবাদতে আমরা মশগুল হয়ে আল্লাহতালার নিকট্য লাভ এবং মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ইতিকাফ করার তৌফিক দান করুন। আমিন

আরও পড়ুনঃ   পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী রাজশাহী আসবেন বুধবার

(লেখক: তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর )
পিআইডি ফিচার